আমাদের সাবজেক্টে হিলারি পাটনামের BIV আর্গুমেন্ট বলে একটা মজার জিনিস আছে। খুব সংক্ষেপে যদি আমরা এটা নিয়ে বলি তাহলে কিছুটা জটিল এই সংশয়বাদী যুক্তিটিকে এভাবে বলতে পারি, একটা মানব-মস্তিষ্ককে যদি পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি পাত্রের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয় এবং তেমন শক্তিশালী কোনো কম্পিউটার থেকে তাকে স্বাভাবিক জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নানা ধরনের অভিজ্ঞতার ইনপুট perception হিসাবে দেয়া হয়, তখন বাদবাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গবিহীন নিছক মস্তিষ্কে সীমাবদ্ধ সেই ব্যক্তি তার দিক থেকে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণেই মনে করবে, সে সত্যিকারের জগতেই আছে, স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছে।

‘দ্যা ম্যাট্রিক্স’ সিনেমাটি এই থিমের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। যারা সিনেমাটি দেখেছেন তারা এটি ভালো বুঝবেন।

বিআইভি আর্গুমেন্ট মূলত একটা থট এক্সপেরিমেন্ট। এর মূলকথা হলো, এমন কী গ্যারান্টি আছে যে আমরা এরকম একটা envated সিচুয়েশনে নাই? হতে পারে আমরা কোনো অধিকতর বুদ্ধিমান কোনো এলিয়েনদের দ্বারা তৈরিকৃত নিছক প্রতিচ্ছবি তথা merely simulated artificial entities!

সত্যি সত্যি কেউ যদি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সিমিউলেইটেড বা এনভেইটেড হয়, সে কিন্তু মনে করবে না যে সে একটা আনরিয়েল-আর্টিফিশিয়াল ওয়ার্ল্ডে বসবাস করছে। বরং সে বা তারা তার বা তাদের কৃত্রিম জগৎটাকেই সত্যিকারের বলে মনে করবে। তার বা তাদের দিক থেকে from narrow content view বা evidentialist point of view’র প্রেক্ষিতে এটাই তো স্বাভাবিক।

তাহলে আমরা কীভাবে বুঝব যে আমরা এ রকমই কৃত্রিম কিছু একটা নই? কীভাবে বুঝব, আমাদের আশেপাশের যে জগত, এটি রিয়েলি রিয়েল? সত্যিকারের প্রাকৃতিক?

এ পর্যায়ে এসে সংশয়বাদের সমর্থকগণ বলবেন, যেহেতু আমরা নিশ্চিত নই যে আমরা সিমিউলেইটেড বা এনভেইটেড নই, সেহেতু আমরা এটিও নিশ্চিত নই যে আমরা আসলে অ-কৃত্রিম বা রিয়েল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জ্ঞানের দাবিকে অসম্ভব প্রমাণ করা কিন্তু স্কেপটিক বা সন্দেহবাদীদের লক্ষ্য নয়। সত্যিকারের বা নিশ্চিত জ্ঞান অসম্ভব, এটি অজ্ঞেয়বাদীদের দাবি। সংশয়বাদ সমর্থনকারীরা বরং জ্ঞানের জন্য যে নিশ্চয়তা লাগে সেটাকে খুঁজে না পাওয়ার দাবি করে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নিশ্চয়তা ছাড়া জ্ঞান হয় না। হোক সে জ্ঞান সত্য, মিথ্যা কিংবা সম্ভাব্য।

সংশয়বাদ কিংবা অজ্ঞেয়বাদের যারা সমর্থক তাদের জন্য একটা বিরাট দুঃসংবাদ হচ্ছে, জ্ঞান একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয়। Knowledge is a must. না জানার কোনো সুযোগ নাই। কী জানেন, কী জানেন না, বা কীভাবে জানেন, সেটা ভিন্ন বিষয়। একেবারে অজ্ঞ হয়ে থাকার কোনো সুযোগ নাই। তত্ত্ববিদ্যা বা অন্টোলজি আমাদেরকে এটাই বলে।

যেমন, সন্দেহবাদীরা সন্দেহ ক্রিয়াকে নিশ্চিত হিসেবে না জেনে সন্দেহবাদী বা সংশয়বাদী হতে পারে না। যেমন করে, অজ্ঞেয়বাদীগণ অজ্ঞেয়বাদকে নিশ্চিত হিসেবে না জেনে সত্যিকারের অজ্ঞেয়বাদী হতে পারেন না।

এই দৃষ্টিতে বলা যায়, সংশয়বাদ এবং অজ্ঞেয়বাদ– এই দুই মতবাদই হচ্ছে counterintuitive, inconsistent, self-contradictory ও self-refuting হাইপোথিসিস।

কথা যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, BIV আর্গুমেন্ট, সেটা দিয়েই এই আলোচনাটা আপাতত শেষ করছি।

দেহবিচ্ছিন্ন ও নিছকই মস্তিষ্কনির্ভর একজন envated পার্সন কখনো নিজেকে এনভেইটেড মনে করবে না। এর যুক্তিটা হচ্ছে এ রকম:

আমাদের বডি থেকে আমাদের ব্রেইন দুইটা জিনিস পায়,

(১) প্রয়োজনীয় ভিটামিন বা পুষ্টি বা শক্তি, যার মাধ্যমে সে জীবিত থাকে এবং

(২) প্রয়োজনীয় সেনসরি ইনপুট, যেগুলোকে আমরা ইন্দ্রিয়জ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পেয়ে থাকি।

কোনো আর্টিফিশিয়াল সিস্টেম থেকে যদি কোনো হিউম্যান ব্রেইনকে এই উভয়বিদ সাপোর্ট অত্যন্ত নিখুঁত বা আইডেন্টিক্যালি দেয়া যায় তাহলে সেই দেহবিচ্ছিন্ন কিন্তু মস্তিষ্কনির্ভর ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ নিজের শরীরে বস্তুগত অস্তিত্বসহ সবকিছুকে বস্তুগতভাবে বাস্তববাদ বা রিয়েল মনে করবে।

এমতাবস্থায় সে নিজের অস্তিত্ব ও আশেপাশের বিদ্যমান বাস্তবতাকে কৃত্রিম কিনা, রিয়েল কিনা, সেটা নিয়ে সন্দেহ করবে না। করার কথা না। আমাদের যুক্তি আমাদেরকে এটাই বলে। অথচ, আমরা সেটাই করি।

আমরা প্রশ্ন করি, ভাবিত হই, যুক্তি নির্মাণ করার চেষ্টা করি, যাচাই করার চেষ্টা করি, আসলেই আমরা একটা বাস্তব জগতে বসবাস করছি কিনা। আমরা জানার চেষ্টা করি, এ জগত আসলে কি বাস্তব? আমাদের মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, স্বপ্নকে যেমস আমরা বাস্তব মনে করি, এই জগতটাও কি আসলে তেমন একটা কিছু? একটি স্বপ্ন? কিংবা, একটা মায়া?

আমাদের এই প্রশ্ন করার মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়, আসলেই আমরা বাস্তব; এবং আমরা একটা বাস্তব জগতেই বসবাস করছি। স্বপ্নের মধ্যে কখনো আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে না, আসলেই আমরা কি বাস্তবে আছি, নাকি স্বপ্নের মধ্যে আছি। আর এ জগৎকে যারা নিছক মায়া মনে করে, তারা জ্ঞানের নিশ্চয়তা শর্তের কাছে হেরে যান।

এ জগৎ ‘মায়া’ হওয়াটা যদি নিশ্চিত হয় তাহলে ‘মায়া নয়, বরং বাস্তব’ এমন একটা কিছু তো পাওয়া গেল। সেটা হলো, ‘এই জগৎ হচ্ছে মায়া’– এই নিশ্চিত জ্ঞান। জগৎ যদি নিছক মায়া হয় সেখানে সত্যিকারের জ্ঞানের উপস্থিতি অসম্ভব।

তারমানে হচ্ছে, এই জগৎ আসলে মায়া নয়। এখানে বাস্তবতা আছে। বাস্তবতাকে বুঝতে গিয়ে ভুল করা, সেটাও আছে। ভুল করার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, সঠিক বলে কিছু একটা আছে; এবং সেটার সাথে আমাদের কোনো না কোনোভাবে কিছু একটা যোগাযোগও আছে।

ভুল-শুদ্ধ নির্ণয়ের মাপকাঠি বা কারখানা হচ্ছে আমাদের মন। যুক্তি হলো সেটার বাহন। আবেগ হলো চালিকাশক্তি। বিবেক হলো চালক। সত্য হলো লক্ষ্য।

আবেগ তথা দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে যুক্তি প্রয়োগে বেশকম হয়, নির্মিত হয় একই বিষয়ে বিভিন্ন রকমের জ্ঞান। আমাদের জ্ঞানগত ভিন্নতা, এমনকি আমাদের ভুল জ্ঞানও প্রমাণ করে আমরা নিছক বস্তু নই।

কোনো বস্তু কখনো নিজেকে নিয়ে ভাবে না। নিছক নিরেট জড়বস্তু কখনো বিশ্বাসের কোলে আশ্রয় নেয় না। কেননা, বিশ্বাস একটি বস্তু-অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য। বস্তুবাদে বিশ্বাসও এর ব্যতিক্রম নয়।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

আপনার মন্তব্য লিখুন

অনুগ্রহপূর্বক আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহপূর্বক এখানে আপনার নাম লিখুন