ইসলাম হলো দার্শনিকতার উৎকৃষ্টতম ফসল। দর্শনের মূলকথা হলো ইসলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, সব ব্যাপারের মূল হলো আল-ইসলাম, নামাজ হলো এর ভিত্তি এবং জিহাদ এর চূড়া। রাসূল (সা) যখন হেরা পর্বতের গুহায় ‘ধ্যান’ করতেন, তখন আসলে তিনি সেখানে কী করতেন? নিশ্চয়ই আমরা এখন যেভাবে বুঝি সেভাবে তিনি জিকির-মোরাক্বাবা করতেন না। সেখানে তিনি ঘুমাতেও যাননি। পালিয়েও থাকেননি। দারুল আরকামের মতো একটি নিরাপদ স্থান হিসাবেও সেটিকে বেছে নেননি। তিনি ভাবছিলেন, গভীরভাবে, একটা সত্যিকারের জীবনাদর্শ কী হতে পারে, সত্য কী, ন্যায়ের চূড়ান্ত মানদণ্ড কী হতে পারে, মানুষের মুক্তির পথ কী, এ জগতের রহস্য কী, এর কন্টিনিউশন কী হতে পারে ইত্যাদি ধরনের সমস্যা বা প্রশ্ন নিয়ে। এক পর্যায়ে তিনি ওহী লাভ করেন। যার মধ্যে রয়েছে তাঁর আরাধ্য হেদায়েত বা দিকনির্দেশনা। রাসূল (সা) সত্যকে জানা ও পাওয়ার জন্য প্রচলিত ধ্যানধারণাকে অন্ধভাবে গ্রহণ না করে স্বীয় যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে যাচাই করার চেষ্টা করে বুঝেছেন যা কিছু প্রতিষ্ঠিত তার অনেক কিছুই ঠিক নয়। সমাধান কী হবে, তা তিনি গভীরভাবে ভাবছিলেন। আল্লাহ তাঁকে নবুয়তের আলো দিয়ে পথনির্দেশনা দিয়েছেন। রাসূল হওয়ার কারণে তিনি ওহীপ্রাপ্তি পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছেন। সত্যকে পেতে চাইলে আমরা সাধারণ মানুষ হিসাবে ওহী পর্যন্ত পৌঁছতে পারবো না, ইতোমধ্যে ওহী এসে যাওয়ায় তার দরকারও নাই; তবে সত্যকে জানতে চাইলে যে কেউ তা খুঁজে পাবে। চূড়ান্ত ওহী পরবর্তী এই সময়কালের সত্যপ্রাপ্তি হচ্ছে ওহীর সত্যতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট হওয়া, ওহীর সত্যতাকে খুঁজে পাওয়া।

কুরআন কীভাবে মানুষকে ডাকে?

কুরআন মানুষকে বলে চিন্তা-গবেষণা করতে। যেসব বিষয়কে পেরিনিয়্যাল প্রবলেম হিসাবে চিহ্নিত করা হয় সেসব সম্পর্কে জানতে, যাচাই করতে উৎসাহিত করে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনের পাতায় পাতায় যুক্তি দিয়ে মানুষকে বলেছেন, যদিও পরম হিসাবে তিনি শুধু করণীয় সম্পর্কে হুকুম নাযিল করলেও তা বাধ্যতামূলক হতো। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রাসূলের মাধ্যমে দেখিয়েছেন নিদর্শন তথা আয়াত, যা যুক্তিবুদ্ধি তথা বিবেক-জ্ঞান দিয়ে খুঁজে নিতে হয়। জ্ঞানচর্চাকে, বুদ্ধির অনুশীলনকে প্রপাগেইট করা হয়েছে নিয়মিতভাবে। ঈমান বা বিশ্বাস হলো বুঝজ্ঞান অনুসারে পাওয়া একটা সিদ্ধান্ত বা উপসংহার। না বুঝে বিশ্বাস করার কোনো মূল্য নাই।

আমাদের বোধ-জ্ঞান-বিবেচনা-যাচাইয়ের সীমা কতটুকু?

আমাদের বোধ-জ্ঞান-বিবেচনা-যাচাইয়ের সীমা যতটুকুই হোক তা শেষ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এ বিবেচনায় শুধুমাত্র স্বীয় ব্যক্তিগত বুঝজ্ঞানের উপর নির্ভর করা অযৌক্তিক। আবার পরম সত্যকে পাওয়ার জন্য নিজ বুঝজ্ঞানকে বাদ দিতে হবে– এটিও অগ্রহণযোগ্য একটা প্রান্তিকতা। যখন আমরা ডাক্তারের কাছে যাই তখন তার প্রেসক্রিপশনের উপর আপাতদৃষ্টিতে আমি অন্ধভাবে বিশ্বাস করি বটে, কিন্তু তিনি ভালো ডাক্তার কিনা তা যাচাই করেই আমি তার কাছে যাই। দর্শন বিষয়ে উপরের আলোচনায় আমি বলেছি– যখনই আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নেই তখন আমরা যাচাই করেই সেই সিদ্ধান্ত নেই। আবার যাচাই করা মানে একেবারে প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে যাচাই করা নয়। আমরা যুক্তি ও সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করি। যখন আমরা চোখে দেখি তখনও আমরা চোখের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করি।

রাসূলকে রাসূল হিসাবে গ্রহণ করতে হলে বুঝজ্ঞান লাগবে। রেসালতের সত্যতায় নিশ্চিত হওয়ার পর বাকিটুকু বিশ্বাসের বিষয়। এবং এটিই যৌক্তিক। ব্যবহারিক জীবনে কোনো এক্সপার্টের বিষয়ে আমরা যা করে থাকি। গাড়ির ড্রাইভার হতে শুরু করে ডাক্তার পর্যন্ত সবার সাথে। সর্বদাই আমরা স্বীয় বুঝজ্ঞানের উপর থাকি, এমনকি যখন আমরা কাউকে কোনো বিষয়ে আমাকে গাইড করার উপযুক্ত বিবেচনা করে তার নির্দেশনাকে বিনাবাক্যে গ্রহণ করি।

জ্ঞানতত্ত্ব ঈমান তথা ইসলামী জ্ঞানতত্ত্ব:

প্রচলিত পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্ব হলো দ্বন্দ্ববাদী। ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধি– এ দুটি পক্ষ। কারো মতে, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা যে জ্ঞান দেয় সেটি অপরাপর যে কোনো জ্ঞানের চেয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য জ্ঞান। আবার বুদ্ধিবাদীদের মতে কখনো কখনো বুদ্ধির মাধ্যমে আমরা যে জ্ঞান পাই তা-ই সঠিক বা বেটার নলেজ। পাশ্চাত্যের কেউ কেউ স্বজ্ঞার কথা বলেছেন বটে, তবে তারা স্বজ্ঞাকে যতটা সম্ভব সযতনে এড়িয়ে গেছেন। কমনসেন্স নামে কেউ কেউ একে বেনামে স্বীকার করেছেন। অন্যদিকে, ইসলামী জ্ঞানতত্ত্ব সমন্বয়বাদী। এর সর্বনিম্ন স্তর হলো ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা। এর উপরে বুদ্ধি। এর উপরে স্বজ্ঞা (ইলহাম)। স্বজ্ঞার পূর্ণতা তথা পারফেকশন হলো ওহী বা প্রত্যাদেশ। শুধুমাত্র নবীগণই জ্ঞানের এই সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারেন। আমাদের জ্ঞানতত্ত্বে ওহীর পর্যায় হলো যৌক্তিক প্রকল্প। এবং একমাত্র যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক (র‍্যাশনাল) সম্ভাবনা হওয়ার কারণে একে প্রমাণিত ও সত্য হিসাবে আমরা গ্রহণ করি। যদি প্রত্যাদেশকে স্বীকার করা না হয় তাহলে স্বজ্ঞার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা করা যায় না। মূলকথা হলো, আমরা যখন প্রত্যাদেশ-নিঃসৃত কিছু বিশ্বাস করি তখন আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও স্বজ্ঞার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই তা বিশ্বাস বা গ্রহণ করি। কেউ যদি তা সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে না করেন তখন তিনি নিজেকে অবিশ্বাসী হিসাবে আইডেন্টিফাই করলেন। বিশ্বাসী তথা ঈমানদারদের বেলায় জ্ঞানের এই চার স্তরের মধ্যে সামঞ্জস্যতার দিক থেকে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তেমনটি হলে তিনি ওহীর জ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও ওহীবহির্ভূত সব সূত্রকে পুনর্মূল্যায়ন করবেন। এতদসত্ত্বেও এ ধরনের মুমিনের অভিজ্ঞতা ও বুঝজ্ঞান তার জ্ঞানের উৎস হিসাবে বাতিল (নালিফাইড) হলো না। কারণ তিনি স্বীয় অভিজ্ঞতা ও বুঝজ্ঞানের মাধ্যমে প্রত্যাদেশকে সর্বোচ্চ মান হিসাবে পেয়েছেন ও গ্রহণ করেছেন। যেসব বিষয়ে কোনো ঐশী জ্ঞানের কথা সরাসরি বলা নাই, সেক্ষেত্রে তিনি নিজ অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধি মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এটি দ্বন্দ্ব নয়, সমন্বয়।

বিশ্বাসের যৌক্তিকতা স্বরূপ:

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্লাটোর প্রস্তাবনা অনুসারে পাশ্চাত্য দর্শনে জ্ঞানের প্রচলিত সংজ্ঞা হলো knowledge is justified true belief. ১৯৬৩ সালের পর থেকে এই সংজ্ঞাকে মেরামত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেটি অন্য প্রসঙ্গ। মূলকথা হলো, বিশ্বাস ছাড়া জীবন অসম্ভব, সে বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন। সকল জ্ঞানই মূলত বিশ্বাস হলেও বিশ্বাস মাত্রই জ্ঞান নয়। শুধুমাত্র সেসব বিশ্বাসই জ্ঞান হিসাবে গৃহীত হবে যা যাচাইকৃত ও সত্য হবে। এছাড়া শুধু বিশ্বাস স্পষ্টতই অন্ধ বিশ্বাস।

বিশ্বাস হলো যা জানি না তার সম্পর্কে নিশ্চিত হিসাবে কোনো কিছুকে স্বীকার করা – শুধুমাত্র এটুকু বললে ভুল বোঝা সম্ভব। আসলে বিশ্বাস হলো– যা জানি, তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় অজানা সম্পর্কে সর্বোত্তম ও যৌক্তিক অনুমান করে তা সত্য হিসাবে গ্রহণ করা। এভাবেই আমরা ‘গড অফ দ্য গ্যাপস’ নামক নাস্তিকতার যুক্তিকে খণ্ডন করতে পারবো। আল্লাহর সত্ত্বাকে আমরা জানি না বটে, তবে আমরা যা জানি সেসবের জ্ঞানগত যৌক্তিক পরিণতি হচ্ছেন আল্লাহ। আল্লাহ অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি রেসালতকে না মানা হয়। এ ধারায় সব কিছু যা ইসলামে আছে বা ইসলামের মূলকথা।

When the declaration of the Kalima is a rational conclusion then it is worthy enough. Mere utterance of Kalima is totally useless. Rationality, any sort of rationality is nothing but doing philosophy. Where any argument is not working, it has to be shown with healthy argument that why argumentation is not applicable there. Trust on and submission to authority(ies) is a must for our life to continue, no matter what is/are that/those authority(ies).

এসবি ব্লগ থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

আবু সাইফ: “ঈমান বা বিশ্বাস হলো বুঝজ্ঞান অনুসারে পাওয়া একটা সিদ্ধান্ত বা উপসংহার। না বুঝে বিশ্বাস করার কোনো মূল্য নাই।”

আমার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে, পৃথিবীতে এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যারা ‘মুখলিস’ বটে, কিন্তু না বুঝেই দ্বীনের অনুসরণ করেন, বোধশক্তি খুবই সাধারণ, কোনোমতে টেনেটুনে জীবনটা চালিয়ে নেন। তাঁদের ‘বিশ্বাসের কোনো মূল্য নাই’ এ কথায় একমত হই কী করে?

আসলে খুব সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে, আর একটু ব্যাখ্যা দরকার।

কী জানি! হয়তো অন্য পাঠকরা সবাই বুঝতে পারছেন, আমি অধম অক্ষম…।

ধন্যবাদ এমন গুরুত্বপূর্ণ পোস্টের জন্য

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: জ্ঞানকে যদি আমরা অক্ষরজ্ঞান ও জটিল বিশ্লেষণের উপস্থাপনা হিসাবে না ধরে বুঝ তথা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হিসাবে ধরি তাহলে আপাত অবুঝরাও মূলত অবুঝ নন। সর্বনিম্ন মানের নিচের অবুঝ হলে তিনি ইসলামকে বুঝতেন না, গ্রহণ করতেন না। অবশ্য, শুধুমাত্র জন্মসূত্রে মুসলিম যারা তাদের কথা আমি ভাবছি না।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

নোমান সাইফুল্লাহ: আমার একটা বিষয় জানার ছিল। যারা ওহীর জ্ঞানে বিশ্বাস করেন না। তারা কীভাবে সত্য লাভ করেন? বা ওহীর জ্ঞান সত্যের একমাত্র উৎস কিনা? ইসলামের দার্শনিক ব্যাখ্যা আধুনিক দার্শনিকদের মধ্যে কারা কারা দিয়েছেন? মুসলমানরা বর্তমানে দর্শন চর্চায় পেছনে পড়ে আছে কেন?

আমাদের কাছে জ্ঞান দুরনেরনাজিলকৃত জ্ঞান (Revealed Knowledge ওহী) অর্জিত জ্ঞান (acquired knowledge thorough scientific method)

এই বক্তব্যটি একটু বিশ্লেষণ করুন।

দর্শন শাস্ত্রের জনক অনুসরণকারীদের কাছে ওহীর জ্ঞানের কোনো প্রয়োজন নেইতারা তাদের চিন্তাপ্রসূত ধারণা দিয়ে সত্য উপলব্ধি করেন

ঠিক কারণেই আমাদের উলামারা দার্শনিকদের বিরোধিতা করেছেনঅ-বস্তু সংক্রান্ত জ্ঞানের জন্য আমরা শুধু ওহীর দ্বারস্থ হই, কোনো দার্শনিকের নই

এই বক্তব্যটিও একটু বিশ্লেষণ করুন।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: পাশ্চাত্য দর্শনে অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির দ্বন্দ্বের মতো রিভিল ও ইম্পিরিক্যাল নলেজের এই দ্বন্দ্ব অমূলক। ইম্পিরিক্যাল নলেজ যেখানে অসম্ভব সেখানেই শুধু রিভিল নলেজের প্রসঙ্গ। ওহীর জ্ঞান, জ্ঞান চর্চার শুরুতে অ-প্রত্যক্ষ (ফাউন্ডেশনাল) কিন্তু শেষে অবভিয়াস তথা চূড়ান্ত প্রাপ্তি (কনক্রিট ফাইন্ডিংস)।

আল্লাহ তো বলেছেন, তুমি তোমার সকল (ইম্পিরিক্যাল) ক্ষমতা দিয়ে দেখ, আমি আল্লাহ কিনা। তোমার যৌক্তিকতার দাবি হলো আমাকে স্বীকার করে নেয়া। অতএব, আমার কথা মানো। আমার রাসূলকে মানো।

দেখুন আল্লাহ নিজেকে চাপিয়ে দেন নাই। বরং নিজের অথরিটির পক্ষে কোরআনের ছত্রে ছত্রে যুক্তি দিয়েছেন, বিচার-বিবেচনা ও বিবেকের কথা বলেছেন।

আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ ইবাদত তথা রিচ্যুয়ালসের বিষয়গুলো ছাড়া সব বিষয়ে আল্লাহ সুবহানুতায়ালা সংশ্লিষ্ট নির্দেশনার পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেছেন।

আলেমগণ কেন দার্শনিকদের বিরোধিতা করেছেন, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে দার্শনিকদের বিরোধিতা করে ‘দর্শনের খণ্ডন’ নামক কিতাব লিখে আবু হামিদ আল গাযালী নামের একজন আপাদমস্তক আলেম শ্রেষ্ঠতম মুসলিম দার্শনিক হিসাবে পরিগণিত হয়েছেন।

সুতরাং, সমস্যাটা উলামা বনাম দার্শনিকদের; দর্শন বনাম ইসলামের নয়।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

নোমান সাইফুল্লাহ: আরেকটু স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলুন। মনে করুন হেইডেগার বা বার্টান্ড রাসেল– তাঁরা তো অমুসলিম, একজন আবার নাস্তিক। এই ক্ষেত্রে বিষয়টি কে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন। কারণ, একজন অমুসলিম বা একজন নাস্তিক তো ওহীর জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে সত্য খোঁজে না।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ওহী পর্যন্ত যে পৌঁছতে পারলো সে পূর্ণাঙ্গ সত্যকে পেল। যে পৌঁছতে পারলো না তার সত্যতাপ্রাপ্তি খণ্ডিত ও অপূর্ণ থাকলো। সে জন্য পদ্ধতি অর্থাৎ দর্শনের কিছু যায় আসে না।

ধন্যবাদ।

নোমান সাইফুল্লাহ: বিষয়টি আরেকটু ক্লিয়ার হওয়ার জন্য বলছি। ধরুন, একজন অমুসলিম যদি আপনার এ কথাকে দর্শনের ভাষায় অস্বীকার করেন, তার উত্তর কী হবে? এই বিষয়ে আমি খুবই অজ্ঞ। তারপরও আমি জানতে চাচ্ছি, কোনো মুসলিম দার্শনিক কি গবেষণায় প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, সত্যের শেষ স্তর ওহী? এবং তা আধুনিক দর্শন স্বীকার করে নিয়েছে? জানালে উপকৃত হতাম।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: যিনি মানছেন না তাকে আপনার যুক্তি বলবেন। মানা বা না মানা তার বিবেচ্য।

মুসলিম দর্শনে ওহীর স্থান স্বীকৃত। ওহীর স্বরূপ, বিশেষ করে বুদ্ধির সাথে এর সম্পর্ক নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হয়।

ধন্যবাদ।

লোনার: ‘ফালসুফা’ হচ্ছে ইসলামের antithesis। ইসলামকে দর্শন হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করার জন্য আপনাকে সচেতন মাইনাস!!

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: এর আগের পর্বে দর্শন সম্পর্কে প্রদত্ত বক্তব্য ও বর্তমান পর্বে উপস্থাপিত বক্তব্যের আলোকে আপনার বক্তব্য আশা করছি।

থিসিস, এন্টিথিসিস ও সিন্থেসিসের থিওরিটা হেগেলের, যা তার ছাত্র মার্কসের নামে প্রচারিত। আপনি হেগেল-মার্কস অনুসারে ইসলাম ও এর সাথে দর্শনের সম্পর্ককে দেখছেন। কী আর বলবো!!

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

আবূসামীহা: “ইসলাম হলো দার্শনিকতার উৎকৃষ্টতম ফসল। দর্শনের মূলকথা হলো ইসলাম।”

দর্শনের জনক গ্রীকরা। তাহলে তারাও ইসলাম চর্চা করত! এরিস্টটল, সক্রেটিস, প্লেটোরাও তাহলে আমাদের ইসলাম শিখিয়েছেন!

রসূলুল্ললাহ (সা) ফালসাফা (ফিলোসফি) চর্চা করেননি হেরা গুহায়। তিনি তাফাক্কুর করেছেন। রসূলুল্লাহর (সা) জন্মের আগে থেকেই ফালসাফা প্রচলিত ছিল।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: পাশ্চাত্য দর্শনের যে ইতিহাস পড়ানো হয় তাতে গ্রীসের আইওনিয়ার অধিবাসী থেলিসকে দর্শনের জনক বলা হয়। আপনি ঠিকই বলেছেন।

কিন্তু যা আপনার বক্তব্যে আসেনি তা হচ্ছে প্রাচ্য দর্শনের দুটি ধারা স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হয়েছে। একটি গ্রিসের আগে, ভারতীয় দর্শন। অন্যটি আরবে ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরে, হযরত হাসান বসরীর হাতে। উনার সহীফা নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসর গ্রহণকারী প্রফেসর ড. মো: বদিউর রহমান একটি সাড়া জাগানো থিসিস করে দেখান যে মুসলিম দর্শন আর ইসলাম একইসাথে এসেছে। বাহিরের প্রভাবে তার উৎপত্তি হয়নি। উনার লেখা বইটি বাজারে পাওয়া যায়।

দর্শন হলো চিন্তার একটি পদ্ধতি। যাতে বুদ্ধি ও বোধের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ প্রয়োগ করা হয়। যু্ক্তি এর হাতিয়ার। আপনার ব্যবহৃত তাফাক্কুরকে বলা যায় এর চালিকাশক্তি।

এর আগের পর্বে এটি বলেছি, দর্শন যে কোনো মত বা পথের ভালো-মন্দ, পক্ষ-বিপক্ষ, যুক্তি-পাল্টাযু্ক্তিকে তুলে ধরে। তাই দর্শন সর্বদা নিরপেক্ষ। কিন্তু যে কোনো দর্শন চর্চাকারী (প্রতিটা ব্যক্তিই প্রতি মুহূর্তে দর্শনচর্চা করে থাকেন, যখনই সে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে) কখনো নিরপেক্ষ হতে পারে না। তিনি কোনো না কোনো যুক্তিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করবেন। এমনকি কিছু না বলাকেও উনি প্রেফার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি উইথহোল্ডিংয়ের পক্ষে! আর দর্শন বিষয়ে পাঠদানকারীর দায়িত্ব হচ্ছে পক্ষ-বিপক্ষকে তুলে ধরা ও নিজের প্রেফারেন্সকে যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়া। এ দৃষ্টিতে প্রফেটরা ফিলোসফি শিক্ষা দেন না। কারণ, তাঁদের সুনির্দিষ্ট পক্ষ থাকে, যাকে তাঁরা একমাত্র সত্য হিসাবে প্রচার করেন। সুতরাং প্রফেটগণ দার্শনিকদের (শিক্ষক অর্থে) মতো নিরপেক্ষ নন। যদিও তাঁদের সত্যপ্রাপ্তি ও তাকে প্রচার-প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি হচ্ছে দর্শনেরই পদ্ধতি।

আপনি ইমাম গাযালীর উদারহণটিই দেখুন। তিনি কখনো নিজেকে দার্শনিক পরিচয় দেয়া তো দূরের কথা, উল্টো গ্রীকদর্শন প্রভাবিত তৎকালীন দার্শনিকদের ২০টি দাবির বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে সেগুলো ঠিক নয়। বইয়ের নাম দিয়েছেন, তাহাফাতুল ফালাসিফা। অথচ, উনাকেই শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মনে করা হয়। কেন? কারণ বিষয়গুলোকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন, যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন। শুধুমাত্র কোরআন-হাদীসের রেফারেন্স দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি।

কোরআন কোনো দার্শনিক গ্রন্থ নয়, যেভাবে আমরা কোনো দার্শনিকের লেখা বই পড়ে থাকি। এটি ওহী। এই ওহীকে স্টাবলিশড করা হয়েছে যুক্তি-তত্ত্ব ও দার্শনিকসুলভ পদ্ধতি ও প্রমাণ দিয়ে।

এতে মানুষের পরিচিত জগত ও সাদামাটা বিষয়গুলোকে বারম্বার ও নানাভাবে রেফার করা হয়েছে সেসব নিয়ে মুক্তমনে চিন্তা গবেষণা করার জন্য। এটিই তো অ্যাম্পিরিক্যাল স্টাডি। তাই না? মানুষের চিন্তনকে গাইড করে একে ঐশী বাস্তবতার দিকে চালিত করা হয়েছে।

যেসব দার্শনিক ঐশী স্তরে পৌঁছতে পারেননি এটি তাদের সীমাবদ্ধতা, দর্শনের নয়। কারণ যারা জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরে তথা ঐশী জ্ঞানে পৌঁছতে পেরেছেন, তারা সুশৃংখল চিন্তা-পদ্ধতির মাধ্যমেই সেটি পেরেছেন। আল্লাহর রাসূলও (সা) এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। হেরা গুহায় তিনি কী করছিলেন সে সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। শুধু এটুকু জানি যে, তিনি ভাবছিলেন। আচ্ছা, তিনি কী ভাবছিলেন? এটি নিশ্চিত যে তিনি নিজ স্বার্থ নিয়ে ভাবছিলেন না। তাঁর ভাবনার বিষয় ছিলো জগত, সমাজ, সমগ্র। সূরা ইনশিরাহর ২ ও ৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় মাওলানা মওদূদী এ কথাই বলেছেন। তাই না?

হ্যাঁ, ফালসাফা রাসূলের (সা) জন্মের আগে থেকে প্রচলিত ছিলো, তবে এই নামে ছিল না। যখন থেকে মানুষ নিজ বুদ্ধি-জ্ঞান দিয়ে কোনো কিছু জানতে চেয়েছে, প্রশ্ন করেছে– তখন থেকে এই চিন্তা ও জ্ঞানগত প্রক্রিয়াও অস্তিত্ব লাভ করেছে।

ফিলোসফি মানে ‘জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ’; ফিলোস মানে জ্ঞান, সোফিয়া মানে অনুরাগ। এটি কীভাবে ইসলামবিরোধী হতে পারে? হতে পারে, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং অন্য অনেক কিছুর মতো ইসলামের পক্ষের লোকেরা এসব ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছেন না বলে ইসলামবিরোধীরা উপরের এক মন্তব্যকারীর ব্যবহৃত শব্দ ‘এন্টিথিসিস’ হিসাবে একে কাজে লাগাচ্ছে।

ইসলামই হচ্ছে মুক্তবুদ্ধি চর্চার মূল ক্ষেত্র। দার্শনিকতার সর্বোত্তম পরিণতি হলো ইসলাম। “রা’সুল আমরি আল-ইসলাম”-এর এটিই মর্মার্থ।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। দীর্ঘ প্রতিমন্তব্যের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

, এম, বিশ্বাস: “আসলে বিশ্বাস হলো– যা জানি, তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় অজানা সম্পর্কে সর্বোত্তম ও যৌক্তিক অনুমান করে তা সত্য হিসাবে গ্রহণ করা।”

আপনার লেখাগুলো পড়ছি, সিরিয়ালি। ভালো লাগছে।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: হ্যাঁ, এটিকে বলে Inference to the Best Explanation (IBE)। এই IBE হলো দর্শন ও বিজ্ঞানের ভিত্তি।

ধন্যবাদ।

এসবি ব্লগের আর্কাইভ লিংক

একটি মন্তব্য

আপনার মন্তব্য লিখুন

অনুগ্রহপূর্বক আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহপূর্বক এখানে আপনার নাম লিখুন