“স্রষ্টা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের ভরকেন্দ্র ও তাঁর ন্যায়পরায়ণতার স্বরূপ” শীর্ষক আমার লেখায় একজন পাঠক প্রশ্ন করেছেন,  “সৃষ্টিকর্তা যদি সৃষ্টির আদিতেও অবস্থান করে থাকেন এবং তাঁর সৃষ্টির আগে যদি সবকিছুই অনস্তিত্বশীল হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি হিসাবে আমাদের অস্তিত্ব কি তাঁর সত্ত্বার অংশমাত্র নয়?”

আমার উত্তর:

না।

জগত সৃষ্টির আগে, ফেরেশতা সৃষ্টির আগে, কোনো কিছু সৃষ্টির আগে শুধু স্রষ্টা ছিলো। এরপর ক্রমান্বয়ে তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। স্রষ্টার দিক থেকে তিনি স্বয়ং ছাড়া কোনোকিছুই স্বয়ং অস্তিত্বশীল নয়। সৃষ্টি করার মাধ্যমে তিনি যা কিছুকে আমরা সৃষ্ট হিসাবে জানি বা জানতে পারি বা আমরা জানতে না পারলেও তাঁর সৃষ্টি হিসাবে যা কিছু অস্তিত্বশীল, যেই ফরমেটেই হোক না কেন, তার সবই স্ব স্ব অস্তিত্বের জন্য স্রষ্টার ওপর নির্ভরশীল। যদিও স্রষ্টা কোনোভাবেই স্বীয় অস্তিত্বের জন্য সৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল নন।

এবার ঋদ্ধ পাঠক, আপনিই বলুন, স্রষ্টা কেন সৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল হবেন? আপনার যুক্তি কী বলে? আপনার যুক্তি নিশ্চয়ই এ কথা বলে, স্রষ্টা হিসাবে ঈশ্বর সৃষ্টির মুখাপেক্ষী হতে পারেন না। স্রষ্টা আছে কিনা, তা ভিন্ন আলোচনা। স্রষ্টা যদি থেকে থাকেন, তাহলে তিনি স্বয়ম্ভূ ও অনন্য হিসাবেই থাকার কথা। অতএব, আপনি স্রষ্টার অস্তিত্বে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস না করলেও এ কথা স্বীকার করছেন, স্রষ্টা যদি থেকে থাকেন, তাহলে তাঁর স্বয়ম্ভূ ও অনন্য-সাধারণ হওয়াই যুক্তিসংগত।

আর হ্যাঁ, স্রষ্টার অস্তিত্বকে মানবেন কেন? যেহেতু আপনি বস্তুগত অভিজ্ঞতায় তাঁকে পান না, তাই মানবেন না। এই আপনার যুক্তি? তো, প্রাজ্ঞ পাঠক, বস্তুগত অভিজ্ঞতায় স্রষ্টাকে সত্ত্বাগতভাবে পেলে তো তিনি স্রষ্টা বা ঈশ্বরের সংজ্ঞা অনুসারে আর ঈশ্বর হিসাবে গন্য হবেন না। তিনি চাঁদ, তারা বা দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রের মতো কোনো রহস্যঘেরা বস্তুগত সত্ত্বা হবেন। ঈশ্বর বা খোদা হবেন না। কেননা, ঈশ্বর বা খোদা হওয়ার যৌক্তিক দাবী হলো তিনি অতিবর্তী হবেন। তাঁর কাজের মাধ্যমে, এ ক্ষেত্রে সৃষ্টি ও সৃষ্টজগত পরিচালনার মাধ্যমে তাঁর অস্তিত্বশীল হওয়াটা বুঝা যাবে। ব্যস, এতটুকুই।

এর বেশি জানতে চাওয়া যুক্তি-বুদ্ধির খেলাফ। পূর্ববর্তী আলোচনায় তা খোলাসা করার চেষ্টা করেছি। এ নিয়ে এখানে আর বলতে চাচ্ছি না।

আমি স্রষ্টার অস্তিত্বকে মানি এ জগত ও এতে আমার অস্তিত্বের কারণ হিসাবে। আমার ঈশ্বর-বিশ্বাস জগত সম্পর্কে আমার অ-জানার ফলশ্রুতি না। আমার ঈশ্বর-বিশ্বাসের ভিত্তি হলো আমার নিজের সম্পর্কে ও জগত সম্পর্কে, বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমি যা জানি, তারই যৌক্তিক পরিণতি। খোদার সত্ত্বায় বিশ্বাস হলো আমার জ্ঞানের ও আবেগের উপসংহার। জ্ঞানের বিষয়গুলো যুক্তিনির্ভর। আমার বিশ্বাস নিছক জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশ্বাস নয়। বরং এর অতিরিক্ত। খোদার ওপরে আমার বিশ্বাস, আমার নিজের সত্ত্বাগত আবেগ ও জীবনবোধের গভীরতম প্রদেশ হতে উৎসরিত শুদ্ধতম, স্থায়ী ও অনন্য অনুভূতি। জ্ঞান ও যুক্তি এ বিষয়ে সহায় মাত্র। আমার কাছে জ্ঞান, বিজ্ঞান, যুক্তি কিংবা বুদ্ধি স্বয়ং কোনো গন্তব্য নয়, যানবাহনের মতো গন্তব্যে পৌঁছার উপায়।

এতটুকু বলে শুরুর প্রশ্নটির মূল উত্তরটা নিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত কিছু পয়েন্ট নোট-ডাউন করতে চাচ্ছি।

হ্যাঁ,

“…সৃষ্টির আগে যদি সবকিছুই অনস্তিত্বশীল হয় তাহলে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি হিসাবে আমাদের অস্তিত্ব তাঁর সত্ত্বার অংশ…” – এমন মনে হতে পারে। যেমন করে মায়ের পেটে সন্তান জন্মলাভ করে। যেমন করে মাটির ভিতর হতে অংকুরোদগম হয়ে গাছ-পালা বেড়ে উঠে, যেমন করে আসমান হতে বারি বর্ষণ ঘটে ইত্যাদি।

একটা বৃত্তের ভিতরে যা কিছু থাকে তাতো শেষ পর্যন্ত বৃত্তটিরই অংশমাত্র। কথাটা ঠিকই। এই দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, স্রষ্টা যেহেতু সব সৃষ্টি করেছেন, তা সব তাঁর সত্ত্বার কোনো না কোনো ধরনের অংশমাত্রই হবে।

না,

ইসলাম সর্বেশ্বরবাদের বিরোধিতা করে বলেই এই ধরনের অনুমানকে আমি নাকচ করি না। বরং, আপনার আমার সর্বজনস্বীকৃত যুক্তিবোধ ও কাণ্ডজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে আমি এই সর্বেশ্বরবাদী চিন্তাধারার বিরোধিতা করি।

ঈশ্বরকে আমরা কেন মানি? জগতের তাবৎ ঈশ্বর বিশ্বাসীর ঠিক একইভাবে বা একই কারণে ঈশ্বরবিশ্বাস পোষণ করেন না। এবং ঈশ্বরবিশ্বাসের দাবী হিসাবে তারা যা করেন তাও এক ধরনের কর্মকাণ্ড নয়। জগতে এত ধর্মবিশ্বাস থাকার এটি কারণ। আমি সব ধর্মবিশ্বাসীর দায়িত্ব নিতে পারবো না। যেভাবে একজন নাস্তিক বা সংশয়বাদী জগতের সব নাস্তিক বা সংশয়বাদীর দায়িত্ব নিতে পারবে না। ধর্ম বিচিত্র আর অ-ধর্ম সব একইভাবে একফ্রেমে চিত্রিত – এমনও তো নয়। তাই না?

আমি আমার দায়িত্ব নিতে পারি। একজন মুসলমান হিসাবে আমি ইসলামের দায়িত্ব নিতে পারি। ইসলামে তাওহীদের ধারণা সম্পর্কে অমুসলিম ও সংশয়বাদীরা তো বটে, তথাকথিত প্র্যাকটিসিং বা আমলদার মুসলমানদেরও যতটুকু পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত তার উল্লেখযোগ্য ঘাটতি আছে। এমনকি ‘স্মার্ট’ ইসলামিস্টরাও দেখি, তাওহীদের মোটাদাগে ধারণার বাহিরে এর তাৎপর্য সম্পর্কে গোলমেলে ও অস্পষ্ট ধারণা পোষণ করেন। ভাবখানা এমন, ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ’ যখন জেনে ফেলেছি এখন সব মনোযোগ দিতে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ কায়েমের দিকে…! এমন কি, ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ সম্পর্কেও উনাদের স্বচ্ছ ধারণা নাই।

এতক্ষণে কোনো কোনো অসহিষনু পাঠক হয়তো মনে মনে ভাবছেন, উনি ফিলোসফির লোক বলে সবাইকে ফিলোসফি শিখাতে চান…! এমনটা কোনো পাঠক ভাবলে তাঁকে বলছি, হ্যাঁ, আমি সবাইকে ফিলোসফি শিখতে বলি। ইসলামের ফিলোসফি না জানলে আপনি মুসলমানই হতে পারবেন না। এই অতি জরুরী ফিলোসফিকে আপনি আক্বীদা বলেন। ইংরেজীতে বললে একে core concept ছাড়া আর কী বলবেন? তো, এই কোর কনসেপ্ট যে আদতে ফিলোসফি, তা হয়তো আপনি কখনো খেয়াল করেন নাই।

ইসলামে তাওহীদের যে সংজ্ঞা দিয়েছে, ঈশ্বরবিশ্বাস বা স্রষ্টাভাবনার তা-ই একমাত্র সঠিক সংজ্ঞা। ইসলাম এই একটা জায়গাতেই বাইনারির কথা বলে। বাদবাকী সব বিষয়ে ইসলাম কোনো না কোনো ফরমেটে বহুত্ববাদের (pluralism) কথা বলে। তাওহীদবিশ্বাস অনুযায়ী খোদা জগতের বাহিরে, যাকে দার্শনিক পরিভাষায় আমরা অতিবর্তী (transcendent) বলে থাকি। তিনি শুধু জগতের বাহিরেই নন, তিনি অতুলনীয়। অথচ তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতা জগত-বিস্তৃত। তিনি শুধু সৃষ্টিই করেন নাই, তিনি প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষভাবে সব পরিচালনাও করছেন।

এবার পাঠক নিচের কথাগুলোকে খুব খেয়াল করবেন।

আমাদের ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কারণে স্রষ্টা সম্পর্কে আমরা এমন শব্দমালা ব্যবহার করি যা আসলে আমরা ঠিক বুঝাতে চাই না। যেমন, স্রষ্টাকে আমরা God বলি যা পুরুষবাচক। ইংরেজীতে স্রষ্টা বুঝাতে He বা Him শব্দকে ব্যবহার করা হয়। ঈশ্বরকে জগতের বহু ধর্ম পুরুষ বলে মনে করে। সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা মুসলমানেরা আল্লাহ সম্পর্কে সত্যিই যা জানি ও মনে করি, আমাদের ব্যবহৃত সংশিষ্ট শব্দগুলোর পরিভাষাগত মর্মার্থকে (connotation) বিবেচনা না করে শব্দগুলোর বাহ্যিক অর্থ ধরলে তা মারাত্মক ভুল হবে। বিজ্ঞ পাঠক এই পয়েন্ট ধরতে পারলে এবার পরবর্তী আসল কথায় আসি।

এই যে দুই প্যারা উপরে আমি খোদার প্রসংগে “বাহিরে”, “অতুলনীয়”, “জ্ঞান”, “ক্ষমতা”, “প্রত্যক্ষভাবে”, “পরিচালনা” – এ শব্দগুলো ব্যবহার করেছি, এ গুলো আমাদের ভাষার শব্দ। আমরা যদি লিমিটেড ও অপূর্ণ হই, তাহলে আমাদের ভাষারও তো সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি থাকা নিশ্চিত। এভাবে মানব জ্ঞানের ও ভাষার কোনো শব্দই স্রষ্টার সঠিক ও পূর্ণ অর্থ বা মর্মার্থ বহন করতে পারার কথা নয়।

তাহলে উপায় কী? আমরা কীভাবে ঈশ্বরকে জানবো। মানলাম, আমরা যার যার হৃদয় দিয়ে ঈশ্বরকে বুঝবো, তাঁর অস্তিত্বকে অনুধাবন করবো। কিন্তু কীভাবে আমরা এই অনির্বচনীয় বিষয়ে ভাষাকে ব্যবহার করবো? উত্তরটা সহজ। কোনো ভাষাই কোনো ভাবকে বহন করার জন্য সম্পূর্ণ উপযোগী নয়। অন্যান্য সমার্থক শব্দের চেয়ে কোনো শব্দ অধিকতর উপযোগী হতে পারে মাত্র। ভাষা মাত্রই সাংকেতিক বা প্রতীকি ব্যাপার। মুদ্রা যেমন অর্থ নয়, তেমনি ভাষা=জ্ঞান নয়। ভাবই জ্ঞান, ভাষা নয়। যদিও ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের লেনদেন হয়। এ যেন কারেন্সির আদান-প্রদান।

বস্তুজগতে আমরা দেখি, যা শুরুতে থাকে তা পরবর্তীর সাথে সত্ত্বাগতভাবে কোনো না কোনো রূপে বিরাজমান থাকে। শক্তির রূপান্তর ও নিত্যতার সূত্র সম্পর্কে যারা জানেন তারা এটি সহজে বুঝবেন। এভাবে অগ্রবর্তী ও পরবর্তী সম্পর্কের যে ধারাবাহিকতা তা সৃষ্ট জগতের অন্তর্ভূক্ত বস্তুনিচয়ের জন্য প্রযোজ্য। স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্কের জন্য প্রযোজ্য হবে না।

আপনি যদি বলেন, আমাদের যুক্তি বা যুক্তিবিদ্যার নিয়ম তো এই ধরনের সম্পর্কগত সমরূপতা ও ধারাবাহিকতার কথা বলে। রূপান্তরের ক্ষেত্রে সম্পর্কগত মৌলিক সমরূপতা ও ধারাবাহিকতার যুক্তি আমিও মানি। তবে তা বস্তুজগতের অস্তিত্ব ও সত্ত্বাগুলোর ক্ষেত্রেই শুধু প্রযোজ্য। বস্তুজগতের নিয়ম ও যুক্তি দিয়ে যদি আপনি স্রষ্টাকে মাপতে যান তাহলে আপনি আদতে বস্তুবাদী (কু)যুক্তিতেই বহাল থাকলেন। সেটি হলো, উপরে বলেছি, বস্তুগত পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণে আপনি স্রষ্টাকে পান না বা এ ধরনের কোনো অস্তিত্বকে অনুমান করা ছাড়াই আপনার পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ অগ্রসর হতে পারে, তাই বস্তু-অতিরিক্ত কোনো সত্ত্বা নাই।

সোশ্যাল মিডিয়ার এই চিপাগলিতে আমি ফিলোসফি ফলাতে চাই না। তবে, চবি’র দর্শন বিভাগে মনোদর্শনের কোর্স পড়ানো শুরু করার পর হতে বস্তুবাদের পতাকা সেই যে কবে থেকে অর্ধনমিত হয়ে আছে তা dorshon.com এ গেলে খানিকটা ঠাউর করতে পারবেন।

আমাদের যত পর্যবেক্ষণ তা সম্ভবপর হয় কিছু চিন্তনের কিছু চিরন্তন নিয়মের মাধ্যমে। বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, কলাবিদ্যা কিংবা আমাদের দৈনন্দিন জীবন, সবখানে এটি সত্য। এই যে ‘চিরন্তন’ শব্দটা ব্যবহার করলাম এটিও আমাদের দিক থেকে সত্য। স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষে একান্তই তাঁর দিক থেকে, মানে from within বলতে যা বুঝায়, সে অনুসারে খোদার জন্য ‘অ-চিরন্তন’ শুধু নয়, ‘চিরন্তন’ বা কোনো পরিভাষা বা কোনোকিছুই অপরিহার্য নয়। এমনকি এই যে, ‘অপরিহার্য’ শব্দটা বললাম, এটিও মানব-ভাষার একটা শব্দ। মানুষ যা আবিষ্কার করেছে। অন্যদিক থেকে বললে, খোদা যা মানুষকে ‘আবিষ্কার করার’ সুযোগ দিয়েছেন। তাই, মানুষের ভাষা, মানুষের উপযোগীই হবে। তা দিয়ে জগত-অতিবর্তী স্রষ্টার মতো কোনো সত্ত্বাকে পরিপূর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব। এই যে, ‘সংজ্ঞায়িত’ শব্দটা বললাম, তাও খোদার দিক থেকে অপ্রয়োজনীয় ও নিরর্থক রেটরিক। সংজ্ঞা মানুষের দরকার। ‘সংজ্ঞা’ দিয়ে খোদার কাজ কী?

খোদা সম্পর্কে আমরা জানি। যে কেউ জানতে পারে। মানুষ ও জ্বীন ছাড়া সবাই এমনিতেই জানে ও পরিপূর্ণভাবে মানে। তাই তো তারা প্রতিনিয়ত আল্লাহতায়ালার তাসবীহ করে। মানুষ খোদা সম্পর্কে জানে, এর মানে এই নয়, মানুষ খোদার সত্ত্বা (Entity or Being) সম্পর্কে জানে। বরং মানুষ খোদা সম্পর্কে জানে মানে তাঁর মহান সত্ত্বার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে। তাঁর কাজের অংশমাত্র জানে। ব্যক্তির অস্তিত্ব ও তার চতুর্পাশ্বস্থ জগতের মাধ্যমে খোদার কাজের সম্পর্কে সে ধারণা লাভ করে। যা তাকে খোদার অস্তিত্বের স্বীকৃতির দিকে পরিচালনা করে। মানুষ খোদা সম্পর্কে জানে প্রকৃতি অধ্যয়ন ও খোদা প্রদত্ত অহীর মাধ্যমে। মানুষ খোদা সম্পর্কে কখনো পূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে পারবে না। কতটুকু হলে পূর্ণ হবে তা সদা অজ্ঞেয় হওয়ার কারণে, যুক্তিসংগত কারণেই মানুষ খোদা সম্পর্কে কখনো ‘আংশিক’ জ্ঞানও লাভ করতে পারার কথা নয়।

খোদা সম্পর্কে আমরা যা জানি তা খোদার জ্ঞানের কতটুকু অংশ তা কি আমরা জানি? কখনো জানতে পারবো? তা যদি না হয়, তাহলে এটিই বলতে হয়, সত্ত্বাগতভাবে খোদা অজ্ঞেয়। এটি খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কে অজ্ঞেয়বাদীদের (agnostics) অজ্ঞতা নয়। এটি খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসংশয় ও পূর্ণ জ্ঞান লাভকারীদের খোদার সত্ত্বা সম্পর্কিত অজ্ঞতা।

বৃত্তের ভিতরে যা উৎপন্ন হয় তা যদি কখনো বৃত্তকে ছাড়িয়ে যেতে না পারে তাহলে তা কোনো না কোনোভাবে বৃত্তেরই অংশ – আমাদের এই যে যৌক্তিক মানবীয় জ্ঞান তা আল্লাহর সত্ত্বার ওপর প্রযোজ্য হবে না। কেননা, আল্লাহ কোনো বৃত্ত নন। তিনি চতুর্ভূজও নন, ষড়ভূজও নন। আসলে তাঁর কোনো আকার নাই। যার কোনো আকারই নাই, তার ওপর কীভাবে আকারের জন্য প্রযোজ্য নিয়ম বা যুক্তি প্রযোজ্য হবে? ধৈর্যশীল পাঠক, আপনার যুক্তি এ ব্যাপারে কী বলে?

নিয়মের স্রষ্টাও কি স্বয়ং নিয়মের অধীন? না। নিয়মের স্রষ্টা যদি স্বয়ং নিয়মের অধীন হন, তাহলে তিনি ‘ভেজাল’ স্রষ্টা। বরং যে নিয়মের তিনি অধীন, সেই নিয়মের স্রষ্টাই হবেন ‘ভেজাল-মুক্ত’ স্রষ্টা। আল্লাহ ওয়াদা রক্ষা করতে বাধ্য নন, যেভাবে আপনি-আমি ওয়াদা রক্ষা করতে বাধ্য। তিনি যেসব বিষয়ে ওয়াদা করেছেন তা তিনি রক্ষা করবেন, আমাদের মতো করে ওয়াদা রক্ষা করার বাধ্যবাধকতার কারণে নন। বরং তিনি বলেছেন। অতএব আমরা যদি তাঁর অস্তিত্বকে মানি, তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যসমূহকে যদি আমরা সঠিক মনে করি, তাহলে আমাদের তো উচিত, তাঁর ওয়াদার ওপর নিঃসংশয় থাকা। কী বলেন? আমি কি ভুল বললাম?

এ জন্য কোরআন ও হাদীসে বার বার সতর্ক করে দেয়া হয়েছে, যেন আমরা আল্লাহর সত্ত্বাকে নিয়ে টানাটানি না করি। অপূর্ণ সত্ত্বা যখন স্বীয় অপূর্ণ ন্যায়-নিক্তি দিয়ে পূর্ণ সত্ত্বাকে মাপতে চায়, যাচাই করতে চায়, তখন সেই অপূর্ণ প্রাকারান্তরে নিজেকে পূর্ণ-সত্ত্বাকে মূল্যায়ন করার মতো যথেষ্ট ক্যাপাবল মনে করে। এটি শির্ক বা পূর্ণ সত্ত্বার সাথে সম-স্বামীত্ব দাবী। আপনার যুক্তির নিয়ম, অংকের নিয়ম বা আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান এ ধরনের নাদানি কাজকর্ম সম্পর্কে কী বলে? একটু শুনতে ইচ্ছা করছে।

রাত অনেক হয়েছে। লেখাটা শেষ করতে চাচ্ছি। তাই সংক্ষেপে বলছি (৩০০০ শব্দের উত্তর। তাও ‘সংক্ষেপে’ বলছি!): অস্তিত্বের জ্ঞান আর সত্ত্বার জ্ঞান এক না। আমার এই লেখার মাধ্যমে আমার অস্তিত্ব জানতে পারছেন। কিন্তু আমি মানে এই লেখাটা না। আবার এই লেখাটা আপনি এখন যা বুঝছেন, তা-ই এই লেখার একমাত্র ও পূর্ণ মানে (meaning) নয়। স্রষ্টা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আমাদের দিক থেকে তাঁর অস্তিত্ব যে আছে শুধুমাত্র এতটুকু উপলব্ধি করা পর্যন্ত যেতে পারে। এর বেশি নয়। এর বাইরে, আমাদের জন্য আল্লাহর যে হেদায়েত বা বাণী তা সবই আল্লাহরই বটে, তবে তা আমাদেরই জন্য, আমাদেরই ভাষায়, আমাদের ভাষাগত ও মর্মার্থ বুঝার ধারণাগত সব অপূর্ণতা ও ত্রুটি নিয়েই।

ভালো থাকুন।

আপনার মন্তব্য লিখুন

অনুগ্রহপূর্বক আপনার মন্তব্য লিখুন!
অনুগ্রহপূর্বক এখানে আপনার নাম লিখুন